প্রথম অধ্যায়
প্রাণিজগতের শ্রেণিবিন্যাস
পৃথিবীতে অসংখ্য বিচিত্র ছোট বড় প্রাণী বাস করে। এদের মধ্যে রয়েছে নানারকম মিল ও অমিল। এই বৈচিত্রময় প্রাণিকুলে রয়েছে আণুবীক্ষণিক প্রাণী অ্যামিবা থেকে শুরু করে বিশাল আকার তিমি। প্রাণীর বিভিন্নতা নির্ভর করে পরিবেশের বৈচিত্রের উপর। ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ ও বাসস্থানে প্রাণিবৈচিত্র্য ভিন্ন রকম হয়। বিশাল এই প্রাণিজগৎ সম্পর্কে জানা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য। সহজে সুশৃঙ্খলভাবে বিশাল প্রাণিজগতকে জানার জন্য এর বিন্যস্তকরণ প্রয়োজন, আর বিন্যস্ত করার পদ্ধতিকে শ্রেণিবিন্যাস বলে। শ্রেণিবিন্যাস প্রাণিজগতকে জানার পথ সহজ করে দিয়েছে।
আমাদের চারপাশে আমরা যে প্রাণীগুলােকে দেখি তার সবগুলাে দেখতে এক রকম হয় না। এদের দেহের আকৃতি , গঠন ও অন্যান্য জৈবিক কাজকর্মের প্রকৃতিও ভিন্ন। এদের কোনােটির মেরুদন্ড আছে, আবার কোনােটির মেরুদন্ড নেই। এদের কোনােটি মাটিতে, কোনােটি পানিতে, কোনােটি গাছে বাস করে। এদের খাদ্যও বিভিন্ন প্রকারের হয়। এরা বিভিন্ন অঙ্গ (সিলিয়া, পা, উপাঙ্গ ইত্যাদি) দিয়ে চলাফেরা করে, আবার কোনােটি চলনশক্তি নেই।
পৃথিবীতে এ রকম বৈচিত্র্যপূর্ণ প্রাণীর সংখ্যা আমাদের সঠিক জানা নেই। আজ পর্যন্ত প্রায় ১৫ লক্ষ প্রজাতির প্রাণী আবিস্কৃত হয়েছে এবং প্রতিনিয়ত এদের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। বিপুল সংখ্যক প্রাণীর গঠন ও প্রকৃতি সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জনের সহজ উপায় হলো শ্রেণিবিন্যাস। প্রাণিদেহে বিদ্যমান বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য ও বিভিন্ন প্রাণীর মধ্যে মিল, অমিল ও পরস্পরের মধ্যে যে সম্পর্ক রয়েছে তার উপর ভিত্তি করে শ্রেণিবিন্যাস করা হয়। এদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিভিন্ন স্তর বা ধাপে সাজানাে হয়। জীবজগৎকে ধাপে ধাপে বিন্যস্ত করার এই পদ্ধতিকে শ্রেণিবিন্যাস বলে। প্রয়ােজনের তাগিদে বর্তমানে জীববিজ্ঞানের একটি স্বতন্ত্র শাখা গড়ে উঠেছে। এর নাম শ্রেণিবিন্যাসবিদ্যা।
প্রজাতি হলাে শ্রেণিবিন্যাসের সবচেয়ে নিচের ধাপ বা একক। যেমন- মানুষ , কুনােব্যাঙ , কবুতর ইত্যাদি এক একটি প্রজাতি। কোনাে প্রাণীর শ্রেণিবিন্যাস করতে হলে সেই প্রাণীকে বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ধাপে ধাপে সাজাতে হয়। এই সকল ধাপের প্রত্যেকটিকে যথাযথভাবে বিন্যস্ত করতে হয়।
শ্রেণিবিন্যাসের ইতিহাসে অ্যারিস্টটল, জন রে ও ক্যারােলাস লিনিয়াসের নাম উল্লেখযােগ্য। প্রকৃতিবিজ্ঞানী ক্যারােলাস লিনিয়াসকে শ্রেণিবিন্যাসের জনক বলা হয়। তিনিই সর্বপ্রথম প্রজাতির বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করেন এবং দ্বিপদ বা দুই অংশ বিশিষ্ট নামকরণ প্রথা প্রবর্তন করেন। একটি জীবের বৈজ্ঞানিক নাম দুই অংশ বা পদবিশিষ্ট হয়। এই নামকরণকে দ্বিপদ নামকরণ বা বৈজ্ঞানিক নামকরণ বলে। যেমন- মানুষের বৈজ্ঞানিক নাম - Homo sapiens। বৈজ্ঞানিক নাম ল্যাটিন অথবা ইংরেজি ভাষায় লিখতে হয়।
এখন তুমি তােমার নিজের খাতায় নিচের ছকটি আঁক এবং ছকটি পূরণ কর-
প্রাণীর নাম বাসস্থান গঠন উপকারিতা অপকারিতা
বানর
কেঁচো
ঝিনুক
পাখি
মাছ
অমেরুদণ্ডী প্রাণীর শ্রেণিবিন্যাস
আধুনিক শ্রেণিবিন্যাসে সকল প্রাণী অ্যানিম্যালিয়া (Animalia) জগতের (kingdom) অন্তর্ভুক্ত। এই শ্রেণিবিন্যাসে পূর্বের প্রােটোজোয়া পর্বটি প্রােটিস্টা (Protista) জগতে একটি আলাদা উপজগৎ (Subkingdom) হিসেবে স্থান পেয়েছে। অ্যানিম্যালিয়া জগতের প্রাণীদের নয়টি পর্বে ভাগ করা হয়েছে। এই নয়টি পর্বের প্রথম আটটি পর্বের প্রাণীরা অমেরুদণ্ডী এবং শেষ পর্বের প্রাণীরা মেরুদণ্ডী।
একনজরে অ্যানিম্যালিয়া জগতের শ্রেণিবিন্যাস
পর্ব
পরিফেরা
নিডারিয়া
প্লাটিহেলমিনথেস
নেমাটোডা
অ্যানেলিডা
অ্যানিম্যালিয়া
আর্থোপােডা
মলাস্কা
একাইনােডারমাটা
কর্ডাটা
কর্ডাটার উপপর্ব
ইউরােকর্ডাটা
সেফালােকর্ডাটা
ভার্টিব্রাটা
ভার্টিব্রাটার শ্রেণি
সাইক্লোস্টোমাটা
কনড্রিকথিস
অসটিকথিস
উভচর
সরীসৃপ
পক্ষীকূল
স্তন্যপায়ী
১. পর্ব : পরিফেরা (Porifera)
স্বভাব ও বাসস্থান: পরিফেরা পর্বের প্রাণীরা সাধারণভাবে স্পঞ্জ নামে পরিচিত। পৃথিবীর সর্বত্রই এদের পাওয়া যায়। এদের অধিকাংশ প্রজাতি সামুদ্রিক। তবে কিছু কিছু প্রাণী স্বাদু পানিতে বাস করে। এরা সাধারণত দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করে।
সাধারণ বৈশিষ্ট্য:
• সরলতম বহুকোষী প্রাণী।
• • দেহপ্রাচীর অসংখ্য ছিদ্রযুক্ত। এই ছিদ্রপথে পানির সাথে অক্সিজেন ও খাদ্যবস্তু প্রবেশ করে।
• কোনাে পৃথক সুগঠিত কলা, অঙ্গ ও তন্ত্র থাকে না।
উদাহরণ : Spongilla , Scypha
২. পর্ব : নিডারিয়া (Cnidaria)
এই পর্ব ইতােপূর্বে সিলেন্টারেটা নামে পরিচিত ছিল।
স্বভাব ও বাসস্থান: পৃথিবীর প্রায় সকল অঞ্চলে এই পর্বের প্রাণী দেখা যায়। এদের অধিকাংশ প্রজাতি সামুদ্রিক। তবে অনেক প্রজাতি খাল , বিল , নদী , হ্রদ , ঝরনা ইত্যাদিতে দেখা যায়। এই পর্বের প্রাণীগুলাে বিচিত্র বর্ণ ও আকার - আকৃতির হয়। এদের কিছু প্রজাতি এককভাবে আবার কিছু প্রজাতি দলবদ্ধভাবে কলােনি গঠন করে বাস করে। এরা সাধারণত পানিতে ভাসমান কা , পাতা বা অন্য কোনাে কিছুর সঙ্গে দেহকে আটকে রেখে বা মুক্তভাবে সাঁতার কাটে।
সাধারণ বৈশিষ্ট্য:
• দেহ দুটি সূণীয় কোষস্তর দ্বারা গঠিত। দেহের বাইরের দিকের স্তরটি এক্টোডার্ম এবং ভিতরের স্তরটি এন্ডােডার্ম।
• দেহ গহ্বরকে সিলেন্টেরন বলে। এটা একাধারে পরিপাক ও সংবহনে অংশ নেয়।
• এক্টোডার্মে নিডােব্লাস্ট নামে এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ কোষ থাকে । এই কোষগুলাে শিকার ধরা, আত্মরক্ষা, চলন ইত্যাদি কাজে অংশ নেয়।
উদাহরণ : Hydra , Obelia
৩. পর্ব : প্লাটিহেলমিনথেস (Platyhelminthes)
স্বভাব ও বাসস্থান: এই পর্বের প্রাণীদের জীবনযাত্রা বেশ বৈচিত্র্যময়। এই পর্বের বহু প্রজাতি বহিঃপরজীবী বা অন্তঃপরজীবী হিসেবে অন্য জীবদেহের বাইরে বা ভিতরে বসবাস করে। তবে কিছু প্রজাতি মুক্তজীবী হিসেবে স্বাদু পানিতে আবার কিছু প্রজাতি লবণাক্ত পানিতে বাস করে। এই পর্বের কোনাে কোনাে প্রাণী ভেজা ও সেঁতসেঁতে মাটিতে বাস করে।
সাধারণ বৈশিষ্ট্য:
• দেহ চ্যাপ্টা, উভলিঙ্গ (একই প্রাণীদেহে পুরুষ ও স্ত্রী প্রজনন অঙ্গ বিদ্যমান)
• বহিঃপরজীবী বা অন্তঃপরজীবী।
• দেহ পুরু কিউটিকল দ্বারা আবৃত।
• দেহে চোষক ও আংটা থাকে।
• দেহে শিখা অঙ্গ নামে বিশেষ অঙ্গ থাকে, এগুলাে রেচন অঙ্গ হিসেবে কাজ করে।
• পৌষ্টিকতন্ত্র অসম্পূর্ণ বা অনুপস্থিত।
উদাহরণ: যকৃৎ কৃমি, ফিতা কৃমি।
৪. পর্ব : নেমাটোডা (Nematoda)
অনেকে একে নেমাথেলমিনথেস বলে।
সভাব ও বাসস্থান: এই পর্বের অনেক প্রাণী অন্তঃপরজীবী হিসেবে প্রাণীর অন্ত্র ও রক্তে বসবাস করে। এসব পরজীবী বিভিন্ন প্রাণী ও মানবদেহে বাস করে নানারকম ক্ষতি সাধন করে। তবে অনেক প্রাণীই মুক্তজীবী, যারা পানি ও মাটিতে বাস করে।
সাধারণ বৈশিষ্ট্য:
• দেহ নলাকার ও পুরু ত্বক দ্বারা আবৃত।
• পৌষ্টিকনালি সম্পূর্ণ, মুখ ও পায়ু ছিদ্র উপস্থিত।
• শ্বসনতন্ত্র ও সংবহনতন্ত্র অনুপস্থিত।
• সাধারণত একলিঙ্গ।
• দেহ গহ্বর অনাবৃত ও প্রকৃত সিলােম নাই। (সিলোম একটি গ্রিক শব্দ যার অর্থ ফাঁপা গহ্বর।)
উদাস্ত্ৰণ : গােলকৃমি , ফাইলেরিয়া কৃমি।
৫. পর্ব : অ্যানেলিডা (Annelida)
স্বভাব ও বাসস্থান: পৃথিবীর প্রায় সকল নাতিশীতােষ্ণ ও উষ্ণমণ্ডলীয় অঞ্চলে এই পর্বের প্রাণীদের পাওয়া যায়। এদের বহু প্রজাতি স্বাদু পানিতে এবং কিছু প্রজাতি অগভীর সমুদ্রে বাস করে। এই পর্বের বহু প্রাণী সেঁতসেঁতে মাটিতে বসবাস করে। কিছু প্রজাতি পাথর ও মাটিতে গর্ত খুঁড়ে বসবাস করে।
সাধারণ বৈশিষ্ট্য:
• দেহ নলাকার ও খণ্ডায়িত।
• নেফ্রিডিয়া নামক রেচন অঙ্গ থাকে।
• প্রতিটি খণ্ডে সিটা থাকে (জোঁকে থাকে না। সিটা চলাচলে সহায়তা করে।)
উদাহরণ : কেঁচো , জোঁক।
৬. পর্ব : আথ্রোপােডা (Arthropoda)
স্বভাব ও বাসস্থান: এই পর্বটি প্রাণিজগতের সবচেয়ে বৃহত্তম পর্ব। এরা পৃথিবীর প্রায় সর্বত্র সকল পরিবেশে বাস করতে সক্ষম। এদের বহু প্রজাতি অন্তঃপরজীবী ও বহিঃপরজীবী হিসেবে বাস করে। বহু প্রাণী স্থলে, স্বাদু পানি ও সমুদ্রে বাস করে। এ পর্বের অনেক প্রজাতির প্রাণী ডানার সাহায্য উড়তে পারে।
সাধারণ বৈশিষ্ট্য:
• দেহ বিভিন্ন অঞ্চলে বিভক্ত ও সন্ধিযুক্ত উপাঙ্গ বিদ্যমান।
• মাথায় একজোড়া পুঞ্জাক্ষি ও অ্যান্টেনা থাকে।
• দেহ নরম, নরম দেহটি কাইটিন সমৃদ্ধ শক্ত আব্বণী দ্বারা আবৃত।
• দেহের রক্তপূর্ণ গহ্বর হিমােসিল নামে পরিচিত।
উদাহরণ : প্রজাপতি, চিংড়ি, আরশােলা, কাঁকড়া।
৭. পর্ব : মলাস্কা (Mollusca)
স্বভাব ও বাসস্থা : এই পর্বের প্রাণীদের গঠন, বাসস্থান ও স্বভাব বৈচিত্র্যপূর্ণ। এরা পৃথিবীর প্রায় সকল পরিবেশে বাস করে। প্রায় সবাই সামুদ্রিক এবং সাগরের বিভিন্ন স্তরে বাস করে। কিছু কিছু প্রজাতি পাহাড়ি অঞ্চলে, বনেজঙ্গলে ও স্বাদু পানিতে বাস করে।
সাধারণ বৈশিষ্ট্য:
• দেহ নরম, নরম দেহটি সাধারণত শক্ত খােলস দ্বারা আবৃত থাকে।
• পেশিবহুল পা দিয়ে এরা চলাচল করে।
• ফুসফুস বা ফুলকার সাহায্যে শ্বসনকার্য চালায়।
উদাহরণ : শামুক , ঝিনুক।
৮. পর্ব : একাইনােডারমাটা (Echinodermata)
স্বভাব ও বাসস্থান : এই পর্বের সকল প্রাণী সামুদ্রিক। পৃথিবীর সকল মহাসাগরে এবং সকল গভীরতায় এদের বসবাস করতে দেখা যায়। এদের স্থলে বা মিঠা পানিতে পাওয়া যায় না। এরা অধিকাংশ মুক্তজীবী।
সাধারণ বৈশিষ্ট্য:
• দেহত্বক কাঁটাযুক্ত।
• দেহ পাঁচটি সমান ভাগে বিভক্ত।
• পানি সংবহনতন্ত্র থাকে এবং নালিপদের সাহায্যে চলাচল করে।
• পূর্ণাঙ্গ প্রাণীতে, অঙ্কীয় ও পৃষ্ঠদেশ নির্ণয় করা যায় কিন্তু মাথা চিহ্নিত করা যায় না।
উদাহরণ : তারামাছ , সমুদ্র শশা।
EmoticonEmoticon